Skip to main content

বকশিগঞ্জ

 এক নজরে বকশীগঞ্জ।।।... 

বকশীগঞ্জ উপজেলা বাংলাদেশের জামালপুর জেলার অন্তর্গত একটি উপজেলা। এটি ৭ টি ইউনিয়ন এবং একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত। এটি ময়মনসিংহ বিভাগের অধীন জামালপুর জেলার ৭ টি উপজেলার একটি এবং এটি জেলার উত্তরভাগে অবস্থিত। বকশীগঞ্জ জামালপুর জেলার সর্ব কনিষ্ঠ উপজেলা। বকশীগঞ্জ উপজেলার উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্য, দক্ষিণে ইসলামপুর উপজেলা, পূর্বে শ্রীবর্দী উপজেলা, পশ্চিমে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা। উপজেলার উত্তর-পূর্বাংশে গারো পাহাড় অবস্থিত।


১৯৩৭ সালে দেওয়ানগঞ্জ থানার অন্তর্ভুক্ত বকশীগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ গঠিত হয়। ৩০ এপ্রিল ১৯৮২ সালে বকশীগঞ্জ থানা এবং ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৮৩ সালে উপজেলা গঠিত হয়। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বকশীগঞ্জ উপজেলা জামালপুর-১ সংসদীয় আসনের অন্তর্ভুক্ত । এ আসনটি জাতীয় সংসদে ১৩৮ নং আসন হিসেবে চিহ্নিত।


বকশীগঞ্জ উপজেলার আয়তন ২০৪.৩০ বর্গ কিলোমিটার এবং জনসংখ্যা ২০১১ সনের আদম শুমারী অনুযায়ী ২,১৮,৯৩০ জন। পুরষ ও নারীর অনুপাত ৯৭ঃ১০০, জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৯১৯ জন, শিক্ষার হার ৩৩.১%।


পটভূমি


ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্ত ঘেষে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে গারো পাহাড়ের পাদদেশে বকশীগঞ্জ উপজেলা অবস্থিত। বকশীগঞ্জের পূর্বনাম রাজেন্দ্রগঞ্জ। ব্রিটিশ শাসনকালে পাতিলাদহ পরগনার জমিদার ছিলেন মহারাজা প্রদ্যুতকুমার ঠাকুর। পাতিলাদহ পরগনা পশ্চিম ময়মনসিংহ ও রংপুর জেলাব্যাপী বিস্তৃত ছিল। জানা যায় ১৭৬৩ সালে ফকির মজনু শাহ ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ করেন। ১৭৭৬ সালে বগুড়ায় মজনু শাহের বাহিনী ও ইংরেজদের মধ্যে প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মজনু শাহ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। পরে বিহারের মাখনপুরে তার মৃত্যু ঘটে। ফকির মজনু শাহের মৃত্যুর পর ফকির আন্দোলন কিছুটা থেমে গেলেও তার শিষ্যরা বিভিন্ন অঞ্চলে বিচ্চিন্ন ভাবে ইংরেজদের আক্রমণ করতে থাকে। ফকির মজনু শাহের একজন শিষ্য হলেন ফকির মাদার বখ্শ। ১৮০০ সালে ব্রিটিশরা কঠোর হস্তে ফকির আন্দোলন দমন করে। এসময় ফকির মাদার বখ্শ পরিবারসহ রাজেন্দ্রগঞ্জ সীমান্তের চরকাউরিয়া সীমারপাড় গ্রামে আগমন করেন। এখানে খনকা স্থাপন করে আধ্যাত্মিক চর্চায় নিয়োজিত হন। কিছু দিনের মধ্যে তার গুণাবলী ছড়িয়ে পড়ে। এক সময় ফকির মাদার বখ্শ বকশী এ অঞ্চলে বকশী ফকির নামে পরিচিতি লাভ করেন। পরবর্তীতে তাঁর নামানুসারেই এ অঞ্চলের নাম হয় বকশীগঞ্জ।


ব্রিটিশ আমলে বকশীগঞ্জ দেওয়ানগঞ্জ থানার একটি গ্রাম ছিল। ১৯৩৭ সালে দেওয়ানগঞ্জ থানার অন্তর্ভুক্ত বকশীগঞ্জ ইউনিয়ন গঠিত হয়।মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে বকশীগঞ্জ থানায় উন্নীত ছিল না। এটি দেওয়ানগঞ্জ থানার অধিনে একটি ইউনিয়ন ছিল। ২৬ এপ্রিল পাকিস্তান বাহিনী এ এলাকায় প্রবেশ করে। ৪ ডিসেম্বর বকশীগঞ্জ হানাদার মুক্ত হয়।১৯৮২ সালের ৩০ এপ্রিল বকশীগঞ্জ থানা এবং ১৯৮৩ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর বকশীগঞ্জ উপজেলা গঠিত হয়।


ভৌগলিক অবস্থান

বকশীগঞ্জ উপজেলা ২৫°০৬´ থেকে ২৫°১৮´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯°৪৭´ থেকে ৮৯°৫৭´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। এর উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্য, দক্ষিণে ইসলামপুর উপজেলা, পূর্বে শ্রীবর্দী উপজেলা, পশ্চিমে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা। উপজেলার উত্তর-পূর্বাংশে গারো পাহাড় অবস্থিত। জেলা সদর থেকে বকশীগঞ্জের দূরত্ব ৫০ কিলোমিটার।


উপজেলার মৌসুমী আবহাওয়া উষ্ণ, আর্দ্র ও নাতিশীতোষ্ণ। গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা ৩০° থেকে ৩৭° সেলসিয়াস থাকে। বৃষ্টিপাত গড়ে ৮৩৪ সি.মি। শীতকালে প্রচন্ড শীত এবং ঘন কুয়াশা হয়। এ অঞ্চলের উত্তরে নদী ও পাহাড়বেষ্টিত ভূমি বেলে ও এঁটেল-দোআঁশ প্রকৃতির এবং অন্যান্য অংশের ভূমি সমতল, উর্বর ও পলিসিক্ত। মোট কৃষিজমির পরিমান ৪৩৬৮৫ একর, আবাদি জমির পরিমান ২৯৫৩৩ একর; সংরক্ষিত বনভূমির পরিমান ১৩.২১ বর্গকিলোমিটার।


প্রশাসনিক এলাকা

বকশীগঞ্জ উপজেলা ৭টি ইউনিয়ন এবং ১টি পৌরসভা নিয়ে গঠিত। এ উপজেলায় ২৫ টি মৌজা, ১৯৯ টি গ্রাম রয়েছে।


পৌরসভা


১. বকশীগঞ্জ পৌরসভা


ইউনিয়ন


ধানুয়া কামালপুর ইউনিয়ন

বগারচর ইউনিয়ন

বাট্টাজোড় ইউনিয়ন

সাধুরপাড়া ইউনিয়ন

বকশীগঞ্জ ইউনিয়ন

নিলক্ষিয়া ইউনিয়ন

মেরুরচর ইউনিয়ন

ব্রিটিশ আমলে বকশীগঞ্জ দেওয়ানগঞ্জ থানার একটি গ্রাম ছিল। ১৯৩৭ সালে দেওয়ানগঞ্জ থানার অন্তর্ভুক্ত বকশীগঞ্জ ইউনিয়ন গঠিত হয়। ১৯৮২ সালের ৩০ এপ্রিল বকশীগঞ্জ থানা এবং ১৯৮৩ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর বকশীগঞ্জ উপজেলা গঠিত হয়। ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ সালে ৯টি ওয়ার্ড ও ৪৭টি গ্রাম নিয়ে বকশীগঞ্জ পৌরসভা গঠিত হয়।


বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বকশীগঞ্জ উপজেলা ও দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা নিয়ে জামালপুর-১ সংসদীয় আসন গঠিত। এ আসনটি জাতীয় সংসদে ১৩৮ নং আসন হিসেবে চিহ্নিত।


নির্বাচিত সাংসদগণ:


নির্বাচন সদস্য দল

  ১৯৭৩ মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন এডভোকেট   বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

  ১৯৭৯ মোহাম্মদ আলমাস হোসেন  

  ১৯৮৬ আব্দুস সাত্তার জাতীয় পার্টি

  ১৯৮৮ আব্দুস সাত্তার জাতীয় পার্টি (এরশাদ)

  ১৯৯১ আবুল কালাম আজাদ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

  ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬   এ, কে, মাইনুল হক বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল

  জুন ১৯৯৬ আবুল কালাম আজাদ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

  ২০০১ এম রশিদুজ্জামান মিল্লাত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল  

  ২০০৮ আবুল কালাম আজাদ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

  ২০১৪ আবুল কালাম আজাদ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

  ২০১৮ আবুল কালাম আজাদ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

স্বাধীনতা যুদ্ধে বকশীগঞ্জ

ধানুয়া কামালপুরে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধ স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধ


মুক্তিযুদ্ধের সময় বকশীগঞ্জ ১১ নং সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বকশীগঞ্জের ধানুয়া কামালপুর ইউনিয়নে বিওপি ক্যাম্প থাকায় মুক্তিযুদ্ধে বকশীগঞ্জ ভৌগোলিক কারণেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১১ সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন যথাক্রমে কর্ণেল তাহের ও লেফট্যানেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান। উইং কমান্ডার হামিদুল্লাহ খান প্রথমে উপ-সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন এবং পরবর্তীতে ১৯৭১-এর ৩ নভেম্বর থেকে সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব লাভ করেন। ৪ ডিসেম্বর বকশীগঞ্জ উপজেলা শত্রু মুক্ত হয় ।


কামালপুর বিওপি যুদ্ধ


বকশীগঞ্জের ধানুয়া কামালপুর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে।ধানুয়া কামালপুরের বিওপি ক্যাম্প ছিল পাকবাহিনীর শক্তিশালী ঘাটি। কৌশলগত কারণে মুক্তিযুদ্ধে ধানুয়া কামালপুর এলাকার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় রণকৌশলগত কারণে মুক্তিবাহিনী বারবার আক্রমণ করেছে এই ঘাটি। এই ধানুয়া কামালপুর ঘাটির এক মাইল দূরে সীমান্তের ওপারে মেঘালয় রাজ্য। মেঘালয়ের সীমান্তবর্তী শহর মাহেন্দ্রগঞ্জে ছিল ১১নং সেক্টরের হেড কোয়ার্টার। ১২ জুন সর্বপ্রথম ইপিআর-এর নায়েক সুবেদার সিরাজের নেতৃত্বে ১৪৮ জন মুক্তিযোদ্ধারা ধানুয়া কামালপুর ঘাঁটি আক্রমণ করে। কিন্তু এই আক্রমণে ঘাঁটির কোন ক্ষতি করা সম্ভব হয়নি। এরপর ৩রা জুলাই ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজের নেতৃত্বে ডেলটা কোম্পানি এবং ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে ব্র্যাভো কোম্পানি ধানুয়া কামালপুর ঘাঁটি আক্রমণ করে। এই আক্রমণে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে মুক্তিবাহিনীর প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে ধানুয়া কামালপুর ঘাঁটি বহুলাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং অনেক পাকসেনা হতাহত হয়। অপরদিকে ক্যাপ্টেন মমতাজসহ ছয়জন মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন এবং অনেক মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে মুক্তিবাহিনী আরও দুবার এই ঘাঁটি আক্রমণ করে। কিন্তু দুবারই তারা এই ঘাঁটি দখল করতে ব্যর্থ হয়। এরপর মুক্তিবাহিনী ধানুয়া কামালপুর ঘাঁটিকে যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে উদ্যোগ নেয়। মুক্তিযোদ্ধারা ধানুয়া কামালপুর ও বকশীগঞ্জের মাঝের সড়কটিতে প্রচুর এন্টি ট্যাংক মাইন স্থাপন করে। এই মাইন বিস্ফোরণে পাকবাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। আগস্ট মাসের শেষের দিকে মাইন বিস্ফোরণে পাকিস্তানিদের নয়টি সরবরাহ ট্রাক এবং সৈন্য বোঝাই ট্রাক ধ্বংস হয়।


মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্স গঠিত হলে যোদ্ধাদের যুদ্ধ ক্ষমতা যাচায়ের জন্য ফোর্স কমান্ডার লে. কর্নেল জিয়াউর রহমানের নির্দেশে একটি যুদ্ধের পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ধানুয়া কামালপুর আক্রমণ ও দখলের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ৩০ জুলাই রাতে আক্রমণের সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারণ করা হয়।


রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী। অন্যান্য অফিসারদের মধ্যে ছিলেন ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান (এ কোম্পানি), ক্যাপ্টেন হাফিজউদ্দিন (বি কোম্পানি), লে. আবদুল মান্নান (সি কোম্পানি), ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ (ডি কোম্পানি) প্রমুখ।


২৯ জুলাইয়ের মধ্যে রেকি করা হয় এবং রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরীর কাছে সকল তথ্য উপস্থাপন করা হয়।


৩১ জুলাই সন্ধ্যার পর নির্দিষ্ট পথে কোম্পানি কমান্ডারগণ নিজ নিজ সৈন্য নিয়ে ধানুয়া কামালপুরের দিকে যাত্রা করেন। কিন্তু যাত্রা পথে হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলে ফর্মিং সেটআপ, ওয়ালেস সিস্টেম জ্যাম হয়ে গেলে আভ্যন্তরীণ যোগাযোগ বিঘ্নিত হয় এবং অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা অল্পপ্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হওয়ায় এবং অনভিজ্ঞ গাইডের কারণে একে অন্যের স্থানে উপস্থিত হয়ে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হলে ফর্মিং আপ করার আগেই নিজেদের এবং শত্রুপক্ষের ক্রস ফায়ারে কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা হতাহত হন।


ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন এবং ক্যাপ্টেন হাফিজউদ্দিন যোদ্ধাদের এগিয়ে যেতে নির্দেশ দেন। বিওপির নিকট পৌছে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মেগাফোনে শত্রুদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। এ সময় কমান্ডারের প্রেরণায় মুক্তিযোদ্ধারা ঘাটি আক্রমণ করেন। মুক্তিবাহিনী একসময় পাক ডিফেন্সের প্রাথমিক আউটার প্যারামিটার দখল করে নেয়। কিন্তু পরক্ষণে পাল্টা আক্রমণের শিকার হয় এবং হাতাহাতি যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে বি কোম্পানি প্রায় পর্যদুস্ত হয়। ক্যাপ্টেন হাফিজ গোলার আঘাতে গুরুতর আহত হন। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিনের নেতৃত্বে বি কোম্পানি পুনরায় ক্যাম্পের উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে এমজি ফায়ারের সম্মুখীন হয়। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন গুরুতর আহত হয়ে অল্পক্ষণের মধ্যেই শহিদ হন। অপরদিকে ডি কোম্পানির অধিনায়ক লে. আবদুল মান্নান আক্রমণের শুরুতেই পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। সার্বিক পরিস্থিতেতে মুক্তিবাহিনী শত্রুর প্রবল আক্রমণের মুখে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিজেদের প্রত্যাহারে বাধ্য হয়।


এ কোম্পানি ৩১ জুলাই রাতে ধানুয়া কামালপুর বকশীগঞ্জ রাস্তায় ধানুয়া কামালপুরের এক মাইল দক্ষিণে ধানুয়া কামালপুর-শ্রীবর্দী রোড জংশন এবং উর্বানীপাড়া এলাকায় রোড ব্লক করে। এর নেতৃত্ব দেন ক্যাপ্টেন মাহবুব। এতে মুক্তিবাহিনী সফল হয়। ধানুয়া কামালপুর বিওপি মুক্তিবাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে এ খবর পেয়ে বকশীগঞ্জ কোম্পানি হেডকোয়ার্টার থেকে ২/৩ ট্রাক পাকসৈন্য সাহায্যকারী হিসেবে আসছিল কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণে পিছু হটতে বাধ্য হয়।


মুক্তিবাহিনীর নিয়মিত ব্রিগেড গঠনের পর এটিই ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম নিয়মিত যুদ্ধ। এলাকা শত্রু মুক্ত করা ছাড়াও প্রশিক্ষণের মান, মনোবল, কমান্ডের প্রতি আনুগত্য ও রেজিমেন্টসমূহের কমান্ডারদের যুদ্ধ পরিচালনার দক্ষতা যাচাই ছিল এর লক্ষ।


এই যুদ্ধে শহিদ হন ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ, নায়েক আবদুস সালাম, ল্যান্স নায়েক গোলাম মোস্তফা, মতিউর রহমান ও নায়েক সিরাজুল ইসলাম সহ আরো অনেকে।


৬ই সেপ্টেম্বর মাঝরাতে মুক্তিবাহিনীর একটি দল ধানুয়া কামালপুর- বকশীগঞ্জ সড়কে এ্যাম্বুশ পাতে। আরেকটি দল ৭ই সেপ্টেম্বর ভোর সকালে ধানুয়া কামালপুর ঘাঁটি আক্রমণ করে। এই অভিযানে মুক্তিবাহিনী ঘাঁটির পূর্বাংশ দখল করলেও পশ্চিম অংশের বাংকার থেকে পাকসেনাদের মেশিনগান ও মর্টারের গোলায় মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধে ২জন মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন এবং ১৭ জন আহত হন। এদিকে এ্যাম্বুশ করা দলের পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে বকশীগঞ্জ থেকে আসা পাকিস্তানি সাহায্যকারি দলের একটি সৈন্য বোঝাই ট্রাক সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংস হয়। এই ট্রাকের পিছনে ছিল একটি জিপ ও একটি সৈন্য বোঝাই ট্রাক। শত্রু সেনারা ট্রাক থপকে নেমে এ্যাম্বুশকারী মুক্তিযোদ্ধাদের উপর গোলাবর্ষণ শুরু করে। দুপক্ষের গুলি বিনিময়ে বেশ কিছু পাকসেনা হতাহত হয়। এই গোলাগুলির সময় ধানুয়া কামালপুর ঘাঁটি থেকে একদল সৈন্য বকশীগঞ্জের দিকে আসে। তারা এ্যাম্বুশকারী মুক্তিবাহিনীর পিছনে অবস্থান নেয় এবং মুক্তিবাহিনীর উপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। এতে ৬জন মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন এবং ৪জন মুক্তিযোদ্ধা পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়েন।এ অবস্থায় এ্যাম্বুশকারী মুক্তিযোদ্ধারা স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ১০ই সেপ্টেম্বর খাসির গ্রামের কাছে পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিবাহিনীর আরেকটি সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এতে অনেক পাকসেনা হতাহত হয়। অন্যদিকে ২জন মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন।


১৩ই নভেম্বর ধানুয়া কামালপুর ঘাঁটির উপর মুক্তিবাহিনী আরেকটি আক্রমণ চালায়। এই যুদ্ধে সাদরুজ্জামান হেলাল কোম্পানি ও তার প্লাটুন এবং ব্রাদার্স কোম্পানি ও তার প্লাটুন অংশ নেয়। এই যুদ্ধে ১১নং সেক্টর কমান্ডার কর্নেল আবু তাহেরও অংশ নেন। পাক হানাদার বাহিনীর সাথে প্রচন্ড রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। তবে এই যুদ্ধে শত্রুদের তেমন ক্ষতি করা যায়নি। কিন্তু এই যুদ্ধে কর্নেল তাহের সেলের আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হন। যার পরিণতিতে তার একটি পা কেটে ফেলতে হয়। কর্নেল তাহের আহত হবার পর ১১ নং সেক্টরের কমান্ডারের পান মানকাচরের সাবসেক্টর কমান্ডার বিমান বাহিনীর অফিসার এম হামিদুল্লাহ খান।


অবশেষে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে ২রা নভেম্বর থেকে ৪ঠা ডিসেম্বর পর্যন্ত চারদিক থেকে ধানুয়া কামালপুর ঘাঁটি অবরুদ্ধ করে রাখে। একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর সদর দপ্তর জামালপুরের সাথে ধানুয়া কামালপুরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এতে পাকবাহিনীর খাদ্য ও গোলাবারুদ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। তাদের মনোবলও ভেঙ্গে পরে। ৪ঠা ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। আত্মসমর্পিত পাকসেনার সংখ্যা ছিল ১৬০ জন। তাদেরকে মিত্রবাহিনী ১০টি ট্রাকে করে ভারতে নিয়ে যায়। ধানুয়া কামালপুর ঘাঁটির পতনের মধ্যদিয়েই সূচিত হয় জামালপুরসহ ঢাকা বিজয়ের পথ।


ধানুয়া কামালপুর যুদ্ধে শহীদ ও খেতাপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামাঙ্কিত স্মৃতিসৌধ


পুরো মুক্তিযুদ্ধে ধানুয়া কামালপুর অভিযানে সর্বমোট ১৯৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন, আহত হয়েছেন অসংখ্য, অন্যদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর আইয়ুব সহ ২২০ জন সেনা নিহত হয়েছেন।


বীর উত্তম, বীর বিক্রম ও বীর প্রতীক মিলিয়ে সর্বমোট ২৯ জন মুক্তিযোদ্ধা সাহসিকতা পদক পেয়েছেন কেবল ধানুয়া কামালপুর যুদ্ধের জন্যই, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এমন উদাহরণ আর একটিও নেই।


জনসংখ্যার উপাত্ত

২০১১ সনের আদম শুমারী অনুযায়ী বকশীগঞ্জ উপজেলার মোট জনসংখ্যা ২,১৮,৯৩০ জন; এর মধ্যে পুরুষ ১,০৭,৭১৮জন এবং মহিরা ১,১১,২১২ জন। পুরুষ ও নারীর অনুপাত ৯৭ঃ১০০ জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৯১৯ জন, শিক্ষার হার ৩৩.১%। বকশীগঞ্জ উপজেলায় গারো, কোচ, আদিবাসি সম্প্রদায়ের লোক বাস করে। আদিবাসিরা মূলত খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। এ উপজেলায় প্রধানত মুসলমান ও হিন্দু এই দুই সম্প্রদায়ের লোকের বসবাস। অন্যান্য ধর্মের লোকসংখ্যা একেবারেই কম। এর মধ্যে মুসলমান জনগোষ্ঠীই সংখ্যাগরিষ্ঠ। জনসংখ্যার মধ্যে মুসলিম ২,১৫,৭৮০, হিন্দু ২,৫২৫, খ্রিস্টান ৫৭৬, বৌদ্ধ ২ এবং অন্যান্য ৪৭ জন।


শিক্ষা

বকশীগঞ্জ উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো সারমারা নাছির উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় (১৯১১), বকশীগঞ্জ নুর মোহাম্মদ উচ্চ বিদ্যালয় (১৯৩৫), নীলক্ষিয়া আর.জে পাইলট উচ্চবিদ্যালয় (১৯৩৫), ধানুয়া কালামপুর কো- অপারেটিভ উচ্চ বিদ্যালয় (১৯৬৪), বকশীগঞ্জ উলফাতুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ইত্যাদি। সারমারা নাছির উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়টি হলো বকশীগঞ্জের প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এটি একটি মাইনর স্কুল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীকালে ১৯৪৮ সালে স্থানীয় ব্যক্তিবর্গের উদ্যোগে এটি হাই স্কুলে উন্নীত হয়। বকশীগঞ্জ নুর মোহাম্মদ উচ্চবিদ্যালয়টি প্রথমে মাদরাসা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। জোতদার ময়েজ উদ্দিন সিদ্দিকী এটি প্রতষ্ঠা করেন। পরে এটি নূর মোহাম্মদ হাই স্কুলে পরিণত হয়।


বকশীগঞ্জ উপজেলার উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো বকশীগঞ্জ কিয়ামতউল্লাহ সরকারি কলেজ, বকশীগঞ্জ খাতেমুন মইন মহিলা ডিগ্রি কলেজ, আলহাজ্ব গাজী আমানুজ্জামান মডার্ন কলেজ, ফারাজীপাড়া মডেল কলেজ, নীলক্ষিয়া পাবলিক কলেজ ইত্যাদি।


মাদ্রাসার মধ্যে আছে বাট্টাজোড় কে.আর.আই ফাজিল মাদ্রাসা।


২০১১ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে বকশীগঞ্জ উপজেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৪৯টি, রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় ৪৯টি, বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (নন রেজিস্টার্ড) ২টি, কিন্ডার গার্টেন ১৫টি, এনজিও স্কুল ১৩৮টি; সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ১টি, বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ২৯টি; স্কুর এন্ড কলেজ ১টি, সরকারি কলেজ ১টি, বেসরকারি কলেজ ২টি; মাদ্রাসা ১৮টি, এবতেদায়ি মাদ্রাসা ২২টি; টেকনিক্যাল এবং ভোকেশনাল ইন্সিটিটিউট ২টি।


স্বাস্থ্য

বকশীগঞ্জ উপজেলায় ৩১ শয্যা বিশিষ্ট একটি সরকারি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ৭টি উপ-স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, ২৩টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। ২০১১ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে বকশীগঞ্জ উপজেলায় ২ টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ৬টি ডায়াগনোস্টিক সেন্টার এবং ১টি মিশনারি হাসপাতাল রয়েছে।


অর্থনীতি

বকশীগঞ্জ উপজেলার অর্থনীতি অনেকটাই কৃষি প্রধান । তবে ব্যবসা ও মানবসম্পদ এই এলাকার অর্থনীতির অন্যতম প্রধান ভিত্তি । প্রধান কৃষি ফসলের মধ্যে - ধান, পাট, গম, তুলা, সরিষা, আখ, মিষ্টি আলু, চ‌িনা বাদাম, ছোলা, মসুর ডাল, হলুদ, পেঁয়াজ, মর‌িচ, ও ব‌িভিন্ন রকমারি শাক-সবজি ইত্যাদি চাষ হয় । বিলুপ্ত বা বিলুপ্তপ্রায় ফসলাদি - ভুট্টা, তিল, তিসি, কাউন, চীনা ইত্যাদ‌িও চাষ হয় । প্রধান ফল-ফলাদি - আম, জাম, কলা, পেঁপে,কাঁঠাল, তরমুজ, প‌েয়ারা, নারক‌েল, আনারস ইত্যাদ‌ি । এ উপজেলায় অনেক মৎস্য, গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির খামা

Comments

Popular posts from this blog

GRE basic info

জেনে নিন GRE জিআরই এর বিস্তারিত তথ্য ও প্রয়োজনীয় সব টিপস ... অবশ্যই আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে সেইভ রাখুন... কেন তা পড়লেই বুঝতে পারবেন ... ▬▬▬▬▬▬ஜ۩۞۩ஜ▬▬▬▬▬▬ জি আর ই কি? “গ্র্যাজুয়েট রেকর্ড এক্সামিনেশন (Graduate Record Examination)” –কে সংক্ষেপে বলা হয় “জি আর ই (GRE)”। এটি মূলতঃ এডুকেশনাল টেস্টিং সার্ভিস (ETS) –এর একটি রেজিস্টার্ড এডুকেশনাল ব্র্যান্ড, তাই একে লেখা হয় GRE®। আমেরিকার ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামে (ব্যাচেলর ডিগ্রির পর এমএস/ পিএইচডি প্রোগ্রাম) ভর্তির জন্য জি আর ই অত্যন্ত জরুরি একটি বিষয়। সোজা কথা GRE একটি সম্পূর্ণ কম্পিউটারাইজড পরীক্ষা যা অনেক দেশের অনেক ইউনিভার্সিটিতে (বিশেষ করে উত্তর আমেরিকাতে) গ্র্যাজুয়েট স্টাডি (মাস্টার্স বা পিএইচডি) করার জন্য লাগে। প্রধানত science & arts ব্যকগ্রাউন্ড এর স্টুডেন্টদের এটা লাগে। Commerce ব্যকগ্রাউন্ডের জন্য লাগে GMAT; তবে অনেক বিজনেস স্কুল আজকাল GRE একসেপ্ট করছে। Why GRE is important? ▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬ অনেক ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটির জন্য শুধুমাত্র সিজিপিএ আর IELTS/TOEFL স্কোর হলেই চলে। কিন্তু আমেরিকা, কানাডার ইউনিভার্সিট...

Bangla calligraphy || Bangla typography|| made by Artist Mosharof

Callygraphy