Skip to main content
ক্রসফায়ার এবং একজন র‍্যাব কর্মকর্তা

রবিউল রক্তশূন্য মুখে কাঁপতে কাঁপতে বলল, স্যার আমারে কি মাইরা ফেলবেন? রবিউল যখন প্রশ্নটা করল তখন আমি সিগারেটে সর্বশেষ টান দিচ্ছি। প্রশ্ন শুনে সেকেন্ডের ভগ্নাংশের জন্য থামলাম। তারপর আবার লম্বা করে টান দিয়ে ঠোঁট গোল করে উপর দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে সিগারেট মাটিতে ফেলে বুট দিয়ে ঘষে আগুন নেভালাম। রবিউলের জবাব না দিয়েই বললাম, ফারুক! ওর চোখ বাঁধো। রবিউল নামের মধ্যবয়সী লোকটা এবার চূড়ান্ত ভয় পেয়ে গেল। এতক্ষণ ধরে তার চোখে মুখে যে সামান্য আশা ছিল সেটা মুহুর্তের মধ্যেই হারিয়ে গেছে। তার কপাল থেকে নিয়ে থুতনী পর্যন্ত পুরো মুখমন্ডল একটা নির্দিষ্ট ছন্দে কাঁপছে। মৃত্যুভয়ে আচ্ছন্ন মানুষকে নতুন দেখছি না। এটাই আমার জীবনের প্রথম ক্রসফায়ার নয়। তারপরও কেন জানি প্রতিবারই দৃশ্যটাকে নতুন মনে হয়। ফারুক চোখ বাঁধার কাপড় খুঁজতে গাড়িতে চলে গেল। আমি বিরক্ত হলাম। গাড়ি থেকে নামার সময়েই জিনিষটা পকেটে করে নিয়ে আসা উচিত ছিল। সবচেয়ে ভালো ছিল গাড়িতেই চোখ বেঁধে রেখে দিতে পারলে। এসব কাজে দেরি করার কোনো মানে নেই। ঝামেলা যত দ্রুত সরানো যায় ততই মঙ্গল। “স্যার আমারে কি মাইরা ফেলবেন?” রবিউল দ্বিতীয়বারের মতো এই প্রশ্ন করলে আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, এত কথা কেন রে বাপ? উত্তর কিছুক্ষণের মধ্যে এমনিতেই পেয়ে যাবা। এখন আল্লাহ খোদার নাম নাও। রবিউল এবার পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে গেল সে মারা যাচ্ছে। এক মুহুর্ত নিষ্প্রাণ চোখে তাকিয়ে তারপর অদ্ভূত এক কাজ করে ফেলল লোকটা। হাতে হ্যান্ডকাফ বাঁধা অবস্থায় ঝপ করে কাঁটা ফলের মতো আমার পায়ের নিচে পড়ে হাউমাউ করে বলল, স্যার আমারে মাইরেন না। আমি নির্দোষ স্যার! ও স্যার গো! আপনার দোহাই গো! কে দোষী আর কে নির্দোষ সেটা ঈশ্বরের পরে যদি কেউ জানে তবে সেটা র‍্যাব-পুলিশ। এই লোকটা যে আপাতমস্তক ভালো মানুষ সেই খবর তার স্ত্রীর অজানা থাকলেও আমাদের অজানা নয়। ভালো মানুষদের নাকি আয়ু কম থাকে, সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি। যুগে যুগে ভালো মানুষদের এই পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে। কে পরাঘাতে মরে নি? সক্রেটিস? কোপার্নিকাস? বান্না? এমনকি যিশু খ্রিষ্টকেও এভাবেই মরতে হয়েছে। যুগের নিয়মই এমন। সভ্যতার রীতি এটাই। আমি নিয়ম পাল্টানোর কেউ নই।? রবিউলকে টেনে হিঁচড়ে মাটি থেকে তোলা হলো। তার গায়ে এই বিস্তীর্ণ মাঠের কিছু ধুলো লেগে গেল। লোকটার কাঁপুনি ক্রমশই বাড়ছে। আমার জানামতে আগামী কাল জোছনা। এই পরিষ্কার আকাশে আজকের রাতটাকেই জোছনা রাত বলে মনে হচ্ছে। চাঁদের আলোয় রবিউলের চোখের কিনার ঘেষে নেমে পড়া অশ্রুর ধারা চিকচিক করছে। বিরাট আকাশের নিচে রাতের এই নির্জনতায় রবিউলকে মনে হচ্ছে সামান্য কীঠ পতঙ্গ, যার জন্ম হচ্ছে কেবলই মৃত্যুর জন্য।? রবিউল আরেকবার ঝুঁকে পড়ার সুযোগ নিতে গিয়ে ব্যর্থ হলো। এবার পেছন থেকে দুইজন তাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। পড়তে না পারলেও সে খানিকটা চিৎকার করে সেই একই কথা বলল, স্যার আমারে মাইরেন না স্যার। আমি নির্দোষ স্যার। আমার দুইটা মেয়ে আছে স্যার। তাদের দেখার কেউ নাই স্যার। আমার বউ খুব অসুস্থ স্যার। আমি উল্টো ঘুরে পকেট থেকে সিগারেট বের করলাম। চারপাশে বাতাস, লাইটারে আগুন ধরাতে একটু সমস্যা হচ্ছে। কাজটাতে নতুন না আমি, তারপরও প্রতিবারই একটু হলে অস্বস্তি লাগে। সিগারেট তখন খুব কাজে দেয়। নিকোটিন রক্ত থেকে অনেকটাই উদ্বেগ কমিয়ে দেয়। যদিও এখানে উদ্বেগের মতো কিছুই নেই। লোকটা আহামরি কেউ না। ছোটখাটো ব্যবসায়ী। সরকারদলীয় এক নেতার টেন্ডারবাজীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে এলাকায় হিরো হয়ে গেছে। স্থানীয় জনতার সহায়তায় নেতার ছেলেকে ধর্ষণ চেষ্টারত অবস্থায় ধরে গণধোলাইয়ের ব্যবস্থা করিয়েছে। তারপর নেতার পুত্রকে গ্রেফতারের জন্য করেছে থানা অবরোধ। লোকটার ভালো পজিশনে বেশ কিছু জমি আছে। নেতা ভদ্রলোক সেই জমি হজম করতে চাইছেন। বাংলাদেশের বাস্তব আইনে মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট পরিমাণ দায় রবিউল জমা করে রেখেছে।? দুই মিনিট হয়ে গেছে। ফারুক আসতে এত দেরি করছে কেন? গুলি করেই কাজ শেষ না। আরো যন্ত্রযোগাড়ের ব্যবস্থা করতে হবে। হাত না চালিয়ে কাজ করলে কীভাবে হয়? রবিউল ঘুরে ফিরে একই আর্তনাদ করেই যাচ্ছে। মুখ বেঁধে রাখলে ভালো হতো। সেটার অবশ্য খুব বেশি দরকার নেই। এই চিৎকার সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কারো কানে পৌঁছাবে না, অবশ্য সৃষ্টিকর্তা যদি শুনতে ইচ্ছুক হোন তবেই। রবিউলের ভেতরেও বোধহয় একই বোধ জাগল। সে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, ও আল্লাহ গো! ও আল্লাহ গো! ও আল্লাহ গো ডাকুক, বেশি করে ডাকুক। এসব বোকা মানুষগুলো ভাবে জগতে ঈশ্বরের একটাই সত্ত্বা। অথচ জগত অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঈশ্বরে বিভক্ত। এই যে রবিউল নামের এই লোকটাকে আমি একটু পরে মারতে যাচ্ছি সেটা নিজের ইচ্ছায় নয়। আমাকে একজন ঈশ্বর আদেশ করেছেন। সেই ঈশ্বরকে আদেশ করেছেন হয়তো আরেকজন, আরেকজনকে আরেকজন, সেই আরেকজনকে অন্য আরেকজন। রবিউল নামের এই সামান্য কাপড় ব্যবসায়ীর ধারণাই নেই তাকে মারার জন্য কত নীরব আয়োজন ঘটে গেছে, কত বছর, কত যুগ আর শতাব্দি ধরে এই আয়োজন চলে আসছে। অথচ সে কেবল আমার দিকেই ঘৃণা নিয়ে তাকিয়ে আছে যেখানে আমার অপরাধটাই সর্বনিম্ন। ফারুক কাপড় নিয়ে এসেছে। গাড়ির কাছে গিয়েই তার পেচ্ছাব চেপেছিল। সেই কাজ করতে গিয়ে একটু দেরি হয়েছে। এই পেচ্ছাব স্বাভাবিক না, শরীরে এনজাইটি বেড়ে যাওয়ার কারণে এমন হয়েছে। ফারুকের মতো কালো কাপড়ের মানুষও যদি এনজাইটিক হয়ে যায়, রবিউল নামের মানুষটার ভেতরে এখন কি হচ্ছে কে জানে! ফারুক চোখ বেঁধে নিল। সর্বশেষ বারের মতো রবিউলের চোখের দিকে তাকালাম আমি। জোছনার আলোয় রবিউলের চোখ গড়িয়ে এখনো পানি পড়ছে। তার সাথে সমস্ত জগতের রাগ, ক্ষোভ, বিস্ময় এবং ঘৃণা। রবিউলের সময় শেষ হয়ে এসেছে। শেষবারের মতোও সে চিৎকার করে বলল, স্যার আমার দুইটা বাচ্চা মেয়ে আছে স্যার। ওরা আজকে কাঁঠাল খাইতে চাইছিল। বছরের প্রথম কাঁঠাল বাজারে উঠছে। ওরা কাঁঠালের আশায় সারা রাত বসে থাকবে স্যার। স্যার আমারে মাইরেন না। আমার দুইটা মেয়ে আছে স্যার। আমার বউ অসুস্থ স্যার। তার ডায়বেটিস, প্রেশার। তারে ডাক্তারের কাছে নেয়ার কেউ নাই। আমি এসব কানে দিলাম না। অভ্যস্ত হাতে হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করলাম। যেহেতু ব্যাপারটাকে বন্দুক যুদ্ধ হিসেবে চালানো হবে সুতরাং বন্দুক দিয়ে গুলি করলে ভালো হতো। এতসব যন্ত্রণায় যাওয়ার দরকার নেই। এটা ইউরোপ আমেরিকা না যে গুলি ল্যাবে নিয়ে পরীক্ষা করা হবে। এটা বাংলাদেশ। এখানে একটা লাশের পেছনে এত সময় দেয়ার কিছু নেই। কেউ খুঁজতেই আসবে না। আমি ট্রিগার টানলাম। “খট” করে একটা শব্দ হলো। এই শব্দ শুনেই রবিউল একেবারে চুপ হয়ে গেল। মানুষের বিশ্বাসের অনেক দেয়াল থাকে। সম্ভবত তার সর্বশেষ দেয়াল এখন ভাঙল। একটু আগেও হয়তো সে ভেবেছে কোনো না কোনো ভাবে সে বেঁচে যাবে। তার দুই বাচ্চাকে কাঁঠাল ভেঙে খাওয়াবে। পিস্তল টানার শব্দে সে বিশ্বাস টুঁটে গেছে। তাকে কালিমা পড়তে বলা উচিত। আমি বললাম না। একবার একজনকে বলেছিলাম। অর্ধ উন্মাদ লোকটা আমার মুখে থু থু দিয়ে বলেছিল “তোর কালিমা তুই পড়। তুইও মরবি একদিন।”
আসলেই কথাটা চমৎকার। সবারই তো মরতে হবে। হত্যা খুব বড় কোনো অপরাধ না। এটা পূর্বনির্ধারিত একটা বস্তু। আজকে আমি এই ক্রসফায়ার না করলে অন্য কেউ করত। আমাদের চারপাশের যে সকল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঈশ্বর, তাদের কাজ কখনো আটকায় না। বরং যারা আটকায়, তাদেরকেই আটকিয়ে দেয়া হয়।
রবিউল বিড়বিড় করে বলল, স্যার আমারে ক্যান মারবেন? এই প্রথমবারের মতো আমি কোনো প্রশ্নের উত্তরে বললাম, জন্মের অপরাধে। জন্মের অপরাধে সকলকেই মরতে হয়। তাছাড়া তুমি ঈশ্বরের দেশে বাস করো ঈশ্বরবিরোধী কর্মকান্ড করেছো। ঈশ্বরের বিচারে তোমার শাস্তি হচ্ছে। এবার আসমানের ঈশ্বরের কাছে যাও। পরের বিচারটুকু তাঁর কাছে গিয়েই দিয়ো। তিনি যদি সত্যিই থেকে থাকেন তবে হয়তো এতদিন সব বিচার করবেন। আমার এত জটিল কথা নেয়ার মতো অবস্থায় রবিউল যে নেই সেটা আমিও জানি। তার ঠোঁট কাঁপছে। আমি স্থির হাতে পিস্তল উঁচিয়ে ধরলাম। চোখ বাঁধার কারণে রবিউল এই দৃশ্য দেখছে না, দেখলে গা মোচড়ামুচড়ি করত। মৃত্যুর প্রতি মানুষের সীমাহীন ভয়, জীবনের প্রতি সীমাহীন আশা। শেষ মুহুর্তেও মানুষ বাঁচার চেষ্টা করে। কেন করে কে জানে! তিন ফুট দূর থেকে আমি রবিউলের বাম বুক তাক করলাম। আমার দলের বাকি তিন সদস্য চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। আমি ট্রিগার চাপতে যাচ্ছি ঠিক এই মুহুর্তে রবিউল বলল, স্যার গো….. আমি থেমে গেলাম। রবিউল বলল, স্যারগো! আপনারও মেয়ে আছে গো স্যার! আমার পাঁচ বছরের একটা মেয়ে আছে এটা এই লোকের জানার কথা না। লোকটা নিশ্চয়ই আন্দাজে বলে ফেলেছে। তবে আন্দাজ কিছুটা কাজ করেছে বলেই সে বাড়তি তিন সেকেন্ড সময় পেয়ে গেল। জীবনের শেষ সময়ে তিন সেকেন্ড সময়ও গুরুত্বপূর্ণ। কতটা দামী সেটা অবশ্য তর্কসাপেক্ষ। আমি রবিউলের বুকে পরপর তিনটি গুলি করলাম। : মানুষের মধ্যে হাজার রকম তফাৎ। ধর্মে, বর্ণে, নামে, চেহারায়, কর্মে সব মানুষই আলাদা। মৃত্যু সব মানুষকেই এক করে ফেলে। গুলি করার পর সবার শরীর থেকে রক্ত বের হয়, কাঁটা ফলের মতো পড়ে যায়। সবাই শেষের দিকে এসে অপার্থিব গোঙানি দেয়। এখানে কোনো তফাৎ সৃষ্টি হয়না। রবিউল মিনিট দুয়েক “মা গো” “পানি পানি” এবং “নাসিমা-ফাহিমা” বলে গোঙাচ্ছিল। একটু আগে সেটা স্থির হয়ে গেছে। নাসিমা-ফাহিমা বোধহয় তার দুই মেয়ের নাম। দুই মেয়ের জন্য আগামীকাল দিনটা ভীষণ যন্ত্রণায় যাবে। ৮ বছর আর ৬ বছরের দুই বাচ্চা হুট করেই আবিষ্কার করবে তাদের বাবা নেই। তাদের বাবা ছিল মাদক ব্যবসায়ী। তাদের বাড়ি পুলিশে আর মানুষে ভরে যাবে। দুইটা বাচ্চা হতবিহ্বল হয়ে তাদের মায়ের মুর্ছা যাওয়া দেখবে। আগামীকাল কবর খোড়া থেকে নিয়ে অশান্তি আর অনিশ্চিত প্রস্তুতির যে জীবন শুরু হবে সেটা আর কোনো দিন থামবে না। প্রস্তুতি আমাদেরও নিতে হবে। লাশের পাশে কয়েকটা গুলির খোসা, কয়েশ পিস ইয়াবা রেখে দিতে হবে। একটা ভাঙাচোরা বন্দুক আছে, সেটা সেট করতে হবে জায়গামতো। লাশের পকেটে মোবাইল ফোনে কিছু রেকর্ড হলো কিনা দেখা দরকার। দূর থেকে কেউ ভিডিও টিডিও করে ফেললে সাময়িক সমস্যায় পড়ে যাব। একটু ঘুরে সেটাও নিশ্চিত করা উচিত। এদেশের মানুষের কল্পনাশক্তি নিম্নশ্রেণীর জীবের চেয়েও কম। এদের চোখের আড়ালে এক লাখ ক্রসফায়ার করলেও মস্তিষ্ক সেসব দৃশ্য কল্পনা করতে পারবে না। অথচ কোনো ভিডিওতে কারো চড় মারা দেখলেই মস্তিষ্কে আলোড়ন সৃষ্টি হয়ে যাবে। আলোড়ন সৃষ্টি হলেও তেমন কিছু হবে না। কিছুদিন আলোচনা হবে। এক সময় দলে দলে ভাগ হবে আলোচনাকারীরা। সামনে আসবে নতুন কোনো আলোড়ন। সেটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে সবাই। তারপরও খুব যদি কিছু হয় তবে দেশে ঈশ্বরেরা আছেন। বাকিটুকু তারাই দেখবেন তারপরও অডিও, ভিডিও থেকে সাবধান থাকা ভালো। সবকিছু শেষ হলে একটা মুখস্ত প্রেস ব্রিফিং দিতে হবে। সেখানে সবকিছু আগে থেকেই টাইপ করা আছে, শুধু এডিট করে রবিউলের নাম আর বয়স বসিয়ে দিলেই হয়। আর দুই ঘন্টার মামলা। তারপর আমি নিশ্চিন্ত। শুধু আজকের জন্য না, আগামী অনেক দিনের জন্য। আসমানের ঈশ্বরই যে তার কাজে পুরষ্কৃত করেন তা না, মাটির ঈশ্বরেরাও তাদের কাজ করে দিলে পুরষ্কারের ব্যবস্থা করে দেন। আমার পুরষ্কার আছে। আসমানের ঈশ্বরের মতো এখানে সময়ক্ষেপণ নেই। এই পুরষ্কার হাতে আসবে খুব দ্রুত। : : আমার স্ত্রী মিলি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, চা খাবে? আমি পত্রিকা পড়ছিলাম। মুখ না তুলেই বললাম, দিতে পারো। মিলি কিচেনের দিকে চলে গেল। আমি পত্রিকা ঘাটাঘাটি করছি। পঞ্চম পৃষ্টার সপ্তম কলামে গিয়ে কাংঙ্খিত খবরটা খুঁজে গেলাম। “র‍্যাবের ক্রসফায়ারে মাদক ব্যবসায়ী নিহত।” “গতকাল রাতে রাজধানীর কেরানীগঞ্জে র‍্যাবের সাথে বন্দুকযুদ্ধে রবিউল ইসলাম (৩৮) নামের এক মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন। নিহত রবিউল ডেমরা এলাকার আব্দুল মালিকের পুত্র। র‍্যাব জানায় গোপন খবরের ভিত্তিতে রবিউলকে নিয়ে মাদক উদ্ধারে বের হয় র‍্যাব। পথমধ্যে রবিউলের সহযোগীরা র‍্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে। র‍্যাবও পাল্টা গুলি চালায়। এক পর্যায়ে পালানোর সময় রবিউল গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। র‍্যাব ঘটনাস্থল থেকে একটি বন্দুক, দুই রাউন্ড গুলি এবং চারশপিস ইয়াবা উদ্ধার করে। এ বিষয়ে কেরানীগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।” খবর পড়ে বরাবরের মতোই আমার হাসি পেল। রবিউলকে ধরা থেকে নিয়ে গুলি করা এবং লাশ মর্গে পাঠানো পর্যন্ত আমাদের ব্যয় হয়েছে সর্বমোট ১১ ঘন্টা। সাংবাদিকরা এত আয়োজন করে করা একটা ঘটনাকে পঞ্চম পাতার সাত নাম্বার কলামে দেড় ইঞ্চির মধ্যেই শেষ করে ফেলেছে। তিলটা গুলি করতে আমার যতটা সময় লেগেছে এই খবর পড়তে লেগেছে তারচেয়েও কম। জীবনের দাম এখন কারো কাছেই বেশি না। না খুনীর কাছে, না সাংবাদিকের কাছে, না রাজার কাছে, না জনগণের কাছে। এককভাবে এই হত্যার দায় আমি কীভাবে নেয়? মিলি চা নিয়ে এসেছে। তার হাঁটার ভঙ্গি কেমন যেন সাপের মতো। আমাদের বিয়ের ৮ বছর হয়ে গেছে। মিলির শরীরে এই আট বছরে কয়েক কেজি মেদ জমেছে। কিন্তু শরীরটা এখনো সেই আগের মতোই আবেদনময়ী। শাড়ির ফাঁক গলে পেটের মধ্যে যে ভাঁজ দেখা যাচ্ছে সেটা এতটুকু দৃষ্টিকটু নয়। মিলি পাশে এসে বসতেই আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম। মিলি কপট রাগ দেখিয়ে বলল, এত আহ্লাদ করার দরকার নাই। আমি মিলির শরীরে চাপ দিয়ে বললাম, তাহলে কি করতে হবে? – সংসারের খবর রাখতে হবে। বউয়ের খবর রাখতে হবে। প্রতিদিন দেরি করে বাসায় ফিরলে বউ অন্য পুরুষ ঘরে ঢোকাবে কিনা সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। – আর? – আর বাচ্চাটার খবর রাখা দরকার। ৫ বছরের একটা বাচ্চা, বাবা বাবা বলে ঘুমিয়ে পড়ে। তারজন্য না একটা খেলনা এরোপ্লেন আনার কথা, সেটা কই? শান্তা দুইদিন আগে এরোপ্লেনের আবদার করেছিল। রবিউলের ব্যস্ততায় সেটা মনেই করতে পারিনি। আহারে, আমার মেয়েটা হয়তো এরোপ্লেনের কথা ভেবে ঘুমাতে পারেনি। এক মুহুর্তের জন্য রবিউলের দুইটা মেয়ের কথা মাথায় আসল। কি যেন নাম? নাসিমা- ফাহিমা। ওরা বাবার কাছে কাঁঠাল খাওয়ার জন্য আবদার করেছিল। বাচ্চা দুইটা কী এ জীবনে আর কোনোদিন কাঁঠাল মুখে দিতে পারবে? অবশ্য তাদের জীবনে ঘোর অন্ধকারের এখনো অনেক বাকি। তাদের জমি দখল হবে, ব্যবসা হাতছাড়া হবে। এক সময় বানের পানির কচুরিপানার মতোই তাদেরকে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো লাগবে। জীবন কতটা নিষ্ঠুর কতটা অন্ধকার তার পূর্ণ শিক্ষা এরা খুব দ্রুত পেয়ে যাবে। মিলি বলল, কি ভাবছ? আমি বললাম, কিছু না। – কিছু তো অবশ্যই। আজকাল তুমি আমাকে অনেক কিছুই বলো না। কোথায় যে কি করে বেড়াচ্ছ কে জানে! মেয়ে টেয়ে নিয়ে হোটেলে উঠলে কিন্তু খবর আছে। স্রেফ খুন করব। খুন করে বিধবা হয়ে যাব। আমি আরেকবারের জন্য রবিউলের বিধবা স্ত্রীর কথা ভাবলাম। মেয়েটার বয়স কত হবে? হয়তো মিলির বয়সীই হবে, কিংবা আরো কম। এই মেয়েটা আজীবন একা থাকবে, কত দীর্ঘ রজনী পার করতে হবে একা একা। মেয়েটার শরীর থেকে মিলির মতোই গন্ধ বেরুবে, সেই গন্ধে পঙ্গপালের মতো ছুটে আসবে পতঙ্গ। দুইটা বাচ্চা মেয়েকে সামলাতে গিয়ে সে নিজে দিশেহারা হয়ে যাবে। এক সময় হয়তো ভুলেই যাবে শরীর কী, মন কী, জীবন কী? রবিউল মাত্র তিনটা গুলিতে উদ্ধার পেয়ে গেছে। এই মেয়ে সারা জীবন বুলেটবিদ্ধ হবে। রবিউলের মতো আর্তনাদ করার অধিকারটুকু সে পাবে না। মিলি ভীষণ আদুরে গলায় বলল, এ্যাই… আমি বললাম, বলো। – চলো না, একবার ঘুরে আসি। – কোথায়? – অজানাতে… – সেটা কী? – যেখানে নদী এসে মিশে গেছে। হাহাহা। – হেয়ালী করছ? – হ্যাঁ করছি। সত্যিই ঘুরে আসি। কতদিন ঘুরিনা। – কোথায় যাবে বলবে তো। – গ্রান্ড সুলতানে যাব। শ্রীমঙ্গল। চারপাশে সবুজ আর সবুজ। মাঝখানে তুমি আর আমি। সুন্দর হবে না? – হ্যাঁ হবে। – কবে যাবে? – আগামী সপ্তাহে। মিলি চিৎকার করে বলল, ও মা সত্যিই? আমি বললাম, হ্যাঁ সত্যিই। রেডি হও। মিলি আমাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে বলল, আমার দাবী মানার জন্য তুমি আমার কাছে পাওনাদার হয়ে গেলে। আজকে তোমার যাবতীয় ঋণ শোধ করা হবে। তার ঠোঁটের কোণে বাকা হাসি। এই হাসির অর্থ আমি জানি। এটা তার বিখ্যাত নিষিদ্ধ হাসি, এটা তার বিখ্যাত বিশুদ্ধ হাসি। আমি তাকে তরল গলায় কিছু বলতে যাব তখনি শান্তা ঘরে ঢুকে বলল, আব্বু! আমি বললাম, জ্বী মা! – আমার হেলিকপ্টার কই? – আছে। কালকেই পেয়ে যাবা। – তুমি আজকে আননি কেন? আজকে যদি হেলিকপ্টারওয়ালা মারা যায়? – মারা যাবে না। আর মারা গেলেও আমি ঠিকই নিয়ে আসব কালকে। – মারা গেলে তখন কীভাবে পাবে? লোকটার তো কবর হয়ে যাবে। আমি ঘড়ির দিতে তাকালাম। সন্ধ্যে সাতটা বাজে। হিসেব মতে আজকে রবিউলের লাশ তার বাড়িতে যাওয়ার কথা। দীর্ঘ আয়োজনের পর এতক্ষণে সম্ভবত তার কবর হয়ে গেছে। সে এখন আসল ঈশ্বরের মুখোমুখি। আসল ঈশ্বর কী তাকে তার প্রাপ্য পুরষ্কারটুকু দেবেন? আমার ঈশ্বর অবশ্য আমার প্রাপ্যটা পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। ব্যাংক একাউন্ট আরেকটু ভারী হয়ে গেছে। সেখান থেকে ক্ষুদ্র একটা অংশ দিয়ে হবে গ্রান্ড সুলতান ট্রিপ। সেখান থেকে ফিরব, ঈশ্বর থেকে চলে আসবে নতুন কোনো নির্দেশনা। আসল আর স্থানীয় ঈশ্বরদের মধ্যে পার্থক্যটা চমৎকার। আসল ঈশ্বর আমাদের সৃষ্টি করেন, আর স্থানীয় ঈশ্বরদেরকে সৃষ্টি করি আমরাই। আসল ঈশ্বরের মতোই স্থানীয় ঈশ্বরদের নিজস্ব ভক্ত থাকে, ধর্ম থাকে। পার্থক্য হচ্ছে আসল ঈশ্বর আজন্ম আরাধনা করেও ভক্ত ঈশ্বর হতে পারে না, ঈশ্বরকে বদলাতে পারে না। তবে এখানে ঈশ্বর বদল আছে, চরম ভক্ত থেকে ছোটখাটো ঈশ্বরে পদন্যোতির সম্ভাবনা আছে। দুই ক্ষেত্রেই ঈশ্বর বড় বেশি একরোখা। নিজেদের তৈরি আইনে তারা “বিরোধ” পছন্দ করেন না। আমি এত কঠিন চিন্তা করছি কেন? ইদানিং কি মাথায় বেশি চাপ পড়ছে? চাপ কমানোর জন্য তাড়াতাড়ি ট্যুরটা করে ফেলতে হবে। শান্তা দৌঁড়ে এসে আমার কোলে চড়ে বসল। আমি তার কপালে লম্বা করে চুমু দিলাম। বাচ্চাটা আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। আমি অনুভব করলাম সেই চিরন্তন বাণী “পৃথিবীতে খারাপ মানুষ আছে, কিন্তু কোনো খারাপ বাবা নেই।” ঠিক তখুনি আমার কানে রবিউলের চিৎকার চলে আসল। “স্যার আমারে মাইরেন না। আমার দুইটা বাচ্চা আছে।” রবিউল বড় বেশি যন্ত্রণা দিচ্ছে তো! এভাবে আগে কেউ দেয়নি। : : আমরা শ্রীমঙ্গল যাচ্ছি। মিলি বাইরে দূরে কোথাও ঘুরতে বের হলে ড্রাইভার নেয়া পছন্দ করে না। তার মতে এতে প্রাইভেসী নষ্ট হয়। সময়টুকু নিজেদের থাকে না। মিলির কারণেই তখন আমাকে ড্রাইভার হয়ে যেতে হয়। আমি ড্রাইভার হিসেবে যথেষ্ট সাবধানী। এখন পর্যন্ত ছোটখোটো কোনো দুর্ঘটনাও ঘটাইনি। তারপরও স্ত্রী সন্তান সাথে থাকলে সামান্য চাপ অনুভব করি। এত দূরের পথে ড্রাইভারকে আনলেই বোধহয় ভালো ছিল। আমরা ভৈরব ব্রীজ পার হয়ে গেলাম। ব্রীজের পাশ ঘেষে রেলসেতু। শান্তা মুগ্ধ হয়ে চারপাশ দেখছে। মেয়েটাকে নিয়ে বাইরে বের হওয়া হয় খুবই কম। এখন থেকে একটু অভ্যেস করিয়ে নিতে হবে। মেয়ের বয়সের তুলনায় ততটা বুদ্ধি হচ্ছে না। এই বয়সের বাবা মায়ের সঙ্গ তার অনেক বেশি দরকার। গাড়িতে রবীন্দ্র সংগীত বেজে চলেছে, “ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে গান।” মিলি গানের তালে তালে মাথা দোলাচ্ছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে তার আনন্দ প্রকাশের ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। গাড়ি ছুটে চলেছে একই গতিতে। বহুদিন পর ড্রাইভ করে আমিও আরাম পাচ্ছি। আমরা হবিগঞ্জে ঢুকে পড়লাম। আর কিছুদূর গেলেই প্রকৃতির অপরূপ রূপ চোখে পড়বে। তারপাশে ঘন সবুজ বন, চা বাগান। মাঝখান দিয়ে রাস্তা। মিলি আর শান্তা আগে কখনো এদিকে আসে নি। তারা ঠিক কতটা যে খুশি হবে ভেবেই আমি আনন্দ পাচ্ছি। তবে আমার আনন্দে সাময়িক ব্যাঘাত ঘটে গেল। সামনে বড় রকমের জ্যাম। এই রাস্তায় জ্যাম হওয়ার কথা না। আমি গাড়ি থেকে মাথা বের করে একজনের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম সামনে একটা ট্রাক এক্সিডেন্ট হয়েছে। ট্রাক আটকে সাময়িক একটা জ্যামের সৃষ্টি হয়েছে। একটু পরেই সেটা খুলে যাবে।
গাড়ি থেকে চাইলে বের হওয়া যায়। এই মুহুর্তে বের হতে ইচ্ছে করল না। আশেপাশে দাঁড়ানোর মতো ভালো জায়গা নেই। বরং গাড়ি থামিয়ে স্ত্রী কন্যার সাথে একটু গল্প করা যায়। আমাদের গাড়ির দুইপাশে আরো দুইটা গাড়ি এসে থেমে গেল। সবার চোখে মুখে বিরক্তি। ট্রাক এক্সিডেন্টে কেউ মারা গেছে কিনা এ খবর কেউ নিচ্ছে না। সবারই মনোযোগ কখন জ্যাম ছাড়বে তার প্রতি। আমি পেছন ঘুরে শান্তাকে জিজ্ঞেস করলাম, মা মণি কেমন আছো? শান্তা বলল, ভালো আছি আব্বু। আর কতদূর? আমি বললাম, এই তো চলে এসেছি। আর সামান্য দূর। তারপরেই পৌঁছে যাব। শান্তা বলল, আমরা সেখানে গিয়ে অনেক মজা করব তাই না? আমি বললাম, হ্যাঁ। অনেক মজা হবে। মিলি আমাকে বলল, তুমি একটু হেঁটে গিয়ে দেখো না কি সমস্যা। এভাবে কতক্ষণ বসে থাকা যায়। – একটু সময় বসলে খুব বেশি ক্ষতি নেই। অপেক্ষা করা ভালো। অপেক্ষা এক ধরণের পরীক্ষা। মিলি চুপ হয়ে গেল। আমি চোখ বন্ধ করে বসে পড়লাম। রবিউলকে ক্রসফায়ার দেয়ার সপ্তাহখানেক হয়ে গেছে। সবকিছু পুরোপুরি শান্ত। আমার ক্রসফায়ার নিয়ে এখনো কোনো সমস্যা হয়নি অবশ্য। কারোরই সমস্যা হয়না। সমস্যা করে বসে কিছু অতি উৎসাহীরা। এরা ফটো তুলে, ভিক্টিমের আর্তনাদ ভিডিও করে মজা নেয়ার জন্য। কোনো না কোনো ভাবে এরা এক সময় ফেঁসে যায়। আমি এসব করিনা, আমার সমস্যাও নেই। তারপরও প্রতিবারই সামান্য খচখচানি কাজ করে কিছুদিন। আমার মনে রবিউল ইস্যু চিরতরে ভুলে যাবার সময় চলে এসেছে। বেলা দুইটা বিশ বাজে। জ্যাম লাগার বিশ মিনিটের মতো হয়ে গেছে। এখনো খোলার নাম নেই। একবার গাড়ি থেকে বের হয়ে খবর নেয়া উচিত। এই ভাবনা যখন এসেছে তখুনি একটা বিদঘুটে “ঝনঝনঝন”শব্দ আমার কানে আসল। ট্রেনের সিগন্যালের শব্দ! এরমানে ট্রেন আসছে। আমি এতক্ষণে খেয়াল করে দেখলাম আমাদের গাড়ি ট্রেন লাইনের উপর দাঁড়িয়ে আছে। এই জিনিষটা আগে কেন লক্ষ্য করিনি? আমি গাড়ির দরজা খুলতে গেলাম। পাশের গাড়ির আমার গাড়ির সাথে চেপে আছে। দরজা খোলা সম্ভব না। দুইপাশের গাড়ির ড্রাইভার গাড়ি দাঁড় করিয়ে বাইরে চলে গেছে। আমি দরজা খুলতে পারছি না। মুখ বের করে চিৎকার করলাম। আশেপাশে কেউ নেই। একটু দূরে কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। এদের চোখে মুখে ভীতি।
গাড়ি সরানোর কোনো উপায় নাই। সামনে পেছনে গাড়ি। আমার গাড়ি সরাসরি লাইনের উপর। পাশের দুই গাড়ির ড্রাইভার গাড়ি রেখে উধাও। কানের মধ্যে অনবরত “ঝনঝনঝন” আওয়াজ বেজেই চলেছে। আমি রক্তশূন্য মুখে মিলির দিকে তাকালাম। মিলি সমান আতংক নিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। খুব সহজ একটা ফাঁদে আমরা আটকা পড়ে গেছি। সবকিছু কেমন জানি অপার্থিব মনে হলো আমার কাছে। প্রকৃতি এত অস্বাভাবিক আয়োজন করে রেখেছিল আমার জন্য? দুইপাশে দুইটা গাড়ি কখন এসে থামল ব্যাপারটা মাথাতেই নিইনি। এভাবে গাড়ি ট্রেনের লাইনে দাঁড় করিয়ে রেখেও মনে কোনো ভয় জাগেনি। অথচ এক মুহুর্তের ব্যবধানে প্রতিটা পশমে মৃত্যু ভয় চলে এসেছে। আমি পাগলের মতো দরজা ধাক্কাতে লাগলাম। তারপর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে সজোরে সামনের গাড়িকে ধাক্কা দিলাম। কিছুই হলো না। ট্রেন খুব কাছ থেকে হুইসেল দিল। মিলি শান্তাকে জড়িয়ে ধরে “ও আল্লাহ, ও আল্লাহ” করছে। এক পর্যায়ে সেও পাগলের মতো দরজা ধাক্কাতে লাগল এবং চিৎকার করে বলল “আমাদের বাঁচান। কে আছেন, বাঁচান প্লিজ।” ট্রেনের শব্দ সরাসরি কানে আসছে। আমার হাতে আর কয়েক মুহুর্ত। আমি গ্লাসে সজোরে ঘুষি বসালাম। কোন কাজ হলো না। একটা পর্যায়ে আমার অস্তিত্ব স্বীকার করে নিল আমি নিজেই আজকে রবিউল। মৃত্যুকে সামনে রেখে অযথাই আর্তনাদ করে যাচ্ছি। আমার ভীত আত্মা কল্পনা করল আমার সামনে রবিউল দাঁড়িয়ে আছে আর আমি তার কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইছি। এক সময় সত্যি সত্যিই আমি চিৎকার করে বললাম, আমারে ক্ষমা করে দেন ভাই। আমার স্ত্রী কন্যা মারা যাবে। তারা দোষ করেনি। ও আল্লাহ, ও আল্লাহ….. মৃত্যু মুহুর্তে যে মানুষের মস্তিষ্ক দ্রুত কাজ করে সেটা আমি বুঝতে পারছি। আমার মস্তিষ্ক বলছে রবিউলের স্ত্রী কন্যাও দোষ করেনি। তারাও শাস্তি পাচ্ছে। একই নিয়মে হয়তো আমার স্ত্রী কন্যাও মারা যাবে। এতদিন পয়েন্ট ব্লাংক রেঞ্জ থেকে গুলি করে সেগুলোকে ক্রসফায়ার বলেছি। এবার জীবনে সত্যিকারের ক্রসফায়ারের মুখোমুখি হচ্ছি আমি। ঐ যে বিশাল ট্রেন এটাই হচ্ছে বুলেট। কোনো অদৃশ্য বিরাট শক্তি সমস্ত আয়োজন করে বুলেট ছুড়েছে। আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে জান্তব গুলি। মিলি পাগলের মতো দরজা ধাক্কা দিচ্ছে। শান্তা মিলিকে জড়িয়ে ধরে আছে। দৃশ্যটা দেখে আমার চোখ ফেটে গেল। সেই ফেটে যাওয়া চোখে ট্রেনটা চোখে পড়ল। আর কয়েক সেকেন্ড! আমি চোখ বন্ধ করলাম। কল্পনায় ধরে নিলাম ফারুক আমার চোখে কাপড় পরিয়ে দিচ্ছে। ট্রেন আরেকবার “পোওও” করল। সেটাকে আমার কাছে ট্রিগার টানার শব্দ মনে হলো। শান্তা শেষ সময়ে “আব্বু” বলে চিৎকার করছে। আমার কাছে মনে হচ্ছে এটা শান্তা না। এটা শান্তা-নাসিমা-ফাহিমার সমন্বিত কণ্ঠ। আমি বুঝতে পারছি প্রতিটা মানুষই কোনো না কোনো সময়ের রবিউল। শুধু সময়টুকুর জন্য অপেক্ষা করতে হয়। ট্রেন একেবারে কাছে চলে এসেছে। প্রথমে আমার সামনের গাড়িকে ধাক্কা মারবে, তারপর আমাদেরকে। আগামীকালকে বনানীতে খোঁড়া হবে পাশাপাশি তিনটি কবর। রবিউলের কবরের পাশে কান্নার মতো মানুষ আছে, আমার কেউ থাকবে না।!!! !আমার খুব বেশি জানতে ইচ্ছে করছে, ক্রসফায়ারের শাস্তিটা কি কেবল আমার হবে? আমার ঈশ্বরেরা কি শাস্তি পাবে না??? (সংগৃহীত)


Comments

Popular posts from this blog

বকশিগঞ্জ

 এক নজরে বকশীগঞ্জ।।।...  বকশীগঞ্জ উপজেলা বাংলাদেশের জামালপুর জেলার অন্তর্গত একটি উপজেলা। এটি ৭ টি ইউনিয়ন এবং একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত। এটি ময়মনসিংহ বিভাগের অধীন জামালপুর জেলার ৭ টি উপজেলার একটি এবং এটি জেলার উত্তরভাগে অবস্থিত। বকশীগঞ্জ জামালপুর জেলার সর্ব কনিষ্ঠ উপজেলা। বকশীগঞ্জ উপজেলার উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্য, দক্ষিণে ইসলামপুর উপজেলা, পূর্বে শ্রীবর্দী উপজেলা, পশ্চিমে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা। উপজেলার উত্তর-পূর্বাংশে গারো পাহাড় অবস্থিত। ১৯৩৭ সালে দেওয়ানগঞ্জ থানার অন্তর্ভুক্ত বকশীগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ গঠিত হয়। ৩০ এপ্রিল ১৯৮২ সালে বকশীগঞ্জ থানা এবং ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৮৩ সালে উপজেলা গঠিত হয়। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বকশীগঞ্জ উপজেলা জামালপুর-১ সংসদীয় আসনের অন্তর্ভুক্ত । এ আসনটি জাতীয় সংসদে ১৩৮ নং আসন হিসেবে চিহ্নিত। বকশীগঞ্জ উপজেলার আয়তন ২০৪.৩০ বর্গ কিলোমিটার এবং জনসংখ্যা ২০১১ সনের আদম শুমারী অনুযায়ী ২,১৮,৯৩০ জন। পুরষ ও নারীর অনুপাত ৯৭ঃ১০০, জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৯১৯ জন, শিক্ষার হার ৩৩.১%। পটভূমি ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্ত ঘেষে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে গারো প...

GRE basic info

জেনে নিন GRE জিআরই এর বিস্তারিত তথ্য ও প্রয়োজনীয় সব টিপস ... অবশ্যই আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে সেইভ রাখুন... কেন তা পড়লেই বুঝতে পারবেন ... ▬▬▬▬▬▬ஜ۩۞۩ஜ▬▬▬▬▬▬ জি আর ই কি? “গ্র্যাজুয়েট রেকর্ড এক্সামিনেশন (Graduate Record Examination)” –কে সংক্ষেপে বলা হয় “জি আর ই (GRE)”। এটি মূলতঃ এডুকেশনাল টেস্টিং সার্ভিস (ETS) –এর একটি রেজিস্টার্ড এডুকেশনাল ব্র্যান্ড, তাই একে লেখা হয় GRE®। আমেরিকার ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামে (ব্যাচেলর ডিগ্রির পর এমএস/ পিএইচডি প্রোগ্রাম) ভর্তির জন্য জি আর ই অত্যন্ত জরুরি একটি বিষয়। সোজা কথা GRE একটি সম্পূর্ণ কম্পিউটারাইজড পরীক্ষা যা অনেক দেশের অনেক ইউনিভার্সিটিতে (বিশেষ করে উত্তর আমেরিকাতে) গ্র্যাজুয়েট স্টাডি (মাস্টার্স বা পিএইচডি) করার জন্য লাগে। প্রধানত science & arts ব্যকগ্রাউন্ড এর স্টুডেন্টদের এটা লাগে। Commerce ব্যকগ্রাউন্ডের জন্য লাগে GMAT; তবে অনেক বিজনেস স্কুল আজকাল GRE একসেপ্ট করছে। Why GRE is important? ▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬ অনেক ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটির জন্য শুধুমাত্র সিজিপিএ আর IELTS/TOEFL স্কোর হলেই চলে। কিন্তু আমেরিকা, কানাডার ইউনিভার্সিট...

Bangla calligraphy || Bangla typography|| made by Artist Mosharof

Callygraphy